কবিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শেষ
অবধি কবিতার স্বপক্ষেই যায়। কবিতার মৃত্যু নেই, তার মৃত্যুই তার জন্ম। কিন্তু
লিখতে এসে একজন কবিকে আগেই যেটা করতে হয়, প্রচলিত কবিতার সেই ধাঁচাটাকে ভাঙতে হয়,
যেটা আসলে একটা গরাদহীন খাঁচা। বাল্মীকির সে চাপ ছিল না, তাঁর আগেকার কোনো ধারণা
নিয়ে তাঁকে কাজ শুরু করতে হয়নি, শুধু ক্রৌঞ্চমিথুনই পর্যাপ্ত ছিল। কিন্তু এমনকি
কালিদাসও সে সুবিধে পাননি। তাঁকেও প্রচলিতকে ভাঙতে হয়েছে- তাঁর আগে যা কিছু
লেখালেখি হয়েছিল, কালিদাস তার ধ্বংসসাধন করেছিলেন, একমাত্র ভাস ছাড়া কেউ তাঁর
মহাপ্লাবনের সামনে টিকতে পারেননি। কালিদাসকে কিন্তু আজও মুছে ফ্যালা গেল না। তিনি
আছেন। মাইকেল তাঁর সময়ে এই একই কাজ করেছেন, রবিবাবু করেছেন। আজও রবিবাবু বহাল
তবিয়তে আছেন। তাঁর পরে আর কোনো বন্যা আসেনি বাংলা কবিতায়। মাঝেমধ্যে ভারি বা
হাল্কা জোয়ার এসেছে, আবার নিজের নিয়মেই ভাঁটা ফিরেছে। আমাদের সকল গান আজও তাঁকে
লক্ষ্য করে। আমাদের কিছু থুতু আজও তাঁর আকাশটির দিকে নিক্ষিপ্ত হয়। তিনি আকাশ,
তিনিই আকাশের ঈশ্বরভাবনা। তাঁকে দেবতা ভাবা চলবে না। তিনি শুধুই খেলার আনন্দ,
আমাদের নিয়ে খেলার। তিনি তাই এসেছিলেন নেমে, আমাদের মধ্যে।
এই মুহূর্তে লিখতে এসে যারা
অন্য-অপর কবিতার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করতে চাইছেন, যারা বিদ্রোহী কবিতাতে আস্থা
রাখছেন, এই মুহূর্তে তাঁদের জন্য একটা গাড্ডা কিন্তু তৈরি হয়ে গ্যাছে। ছন্দ আর অলঙ্কারকে
অস্বীকার করে যা হওয়ার তা তো ৩০০% হয়ে গেছে। এবার ফেরার পালা। কবিতার ক্ল্যাসিক
প্রতিমাকে অস্বীকার তখন করা গিয়েছিল যখন ব্রিটিশ সভ্যতা আর বাঙালি সংস্কৃতির
সবটুকু কাজে লাগিয়ে একটা স্যাচুরেটেড জায়গায় বাংলা কবিতার শরীর পৌঁছে গিয়েছিল। সেই
প্রতিমাকে না ভেঙে আর নতুন খোলামেলা মুক্তমেজাজের প্রতিমা হত না। ওটা ১৯৬০ থেকে
১৯৮০-র দশকের অবধি ঠিক ছিল, তখন কোনো কবি ছন্দে লিখলে তিনি প্রতিষ্ঠানের দাসত্ব
ছাড়া আর কিছু করতেন না। প্রায় ৪ দশক কেটে গেছে ছন্দের কোনো পরোয়া না করে
কবিতাচর্চার। যেটা মুক্তির দরজা ছিল, আজ দেখা যাচ্ছে সেটার চারদিকে কোনো দেওয়াল
নেই, একটা ভগ্নস্তুপ, যেটা থেকে বেরোবার কোনো প্রয়োজন নেই আলাদা করে। ওটাকে এবার
সরিয়ে ফ্যালাই ভাল। এখান থেকে কোনো ব্যক্তি যদি এই ধারণায় পৌঁছন যে অনুপম এবার
অক্ষরবৃত্ত-মাত্রাবৃত্ত-স্বরবৃত্ত বা আনন্দবাজারী বৃত্তে কবিতা লেখার কথা বলছে,
তিনি ভুল করবেন। আমি বলছি স্ব-ছন্দের কথা, যার মধ্যে কবির প্রতিদিনের
বাক্যস্পন্দের স্পর্শ আমরা পাব। সেই সঙ্গে তাঁর স্বাভাবিক মাত্রাবিভাগ, পর্ব ও
যতির বোধ, নিজস্ব শ্বাসাঘাত আমরা পাব। আঙুলের গাঁট গুনে গুনে কবিতা লেখার কথা বলা
হচ্ছে না। অবিশ্যি প্রয়োজন অনুসারে যে কোন বৃত্তে তিনি প্রবেশ আর প্রস্থান করতেই
পারেন। শুধু একটু বাঁকিয়ে অদ্ভুত কথা বলে দিয়েই কেউ যেন আর কবি তকমার আশা না করেন।
ওটা অনেক হল। ‘আমি আজ ভাত খেয়ে অফিসে বসব’- এই বাক্যটি থেকে ‘আমি আজ চাঁপা খেয়ে বাগানে বসব’ লেখার কেরামতি এবার অসহ্য হয়ে পড়ছে।
সত্যিই আজ কবিতার ক্ল্যাসিক অবয়বটিকে ভাঙার হদ্দ হয়ে পচাগলা অবস্থায় পৌঁছেছে। এবার কিন্তু দ্রোহীদের আবার শাশ্বতর দিকে ফিরে যাওয়ার পালা। এই অশিক্ষিত পরিসরে কবিতার কোনো মহিমাই নাহলে আর বাকি থাকবে না। আজ কোবিরা চাইছেন ৫ মিনিটের খ্যাতি। আজকের কোবিতা আগামীকাল মূল্যহীন হয়ে যাচ্ছে। কোথাও সিগনেচারের কোনো মূল্য নেই। এঁরা অস্ত্রশিক্ষা নেওয়ার আগেই বুড়ো আঙুল গচ্ছিত রেখেছেন মাস্টারমশাইদের কাছে- সো কলড সফল কবিরা সেই মাস্টারমশাই। যেহেতু কবিতা লেখা মানেই উচ্চারণের বাঁক ও ব্যঞ্জনা- অনেকেই আজ শিখে নিয়েছে একটু কায়দা করে বাঁকিয়ে কথা কীভাবে বলতে হয়, ছাপার মতো কোবিতা কীকরে লিখতে হয়। এখানে অন্ত্যমিলের কথা বলছি না অবশ্যই। কবি তাঁর পাঠককে অন্ত্যমিলের বাজনা শোনাবেন কিনা, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। অন্ত্যমিলের কোনো ক্ল্যাসিক তাৎপর্য আমি স্বীকার করি না। আমি মনে করি না ৮+৬ মাত্রার হিসেব শুধু যিনি মেলাতে পারেন, অথবা ৭+৫-এর, তাঁকে কবি ভাবার কোনো কারন আছে। শুধু বলছি, ছন্দবোধ যার নেই, যিনি বাক্যের স্পন্দন তাঁর লেখায় জাগাতে পারেন না, জাগালেও তাতে লেগে থাকে হাটবাজার আর অভ্যাসের ছাপ, আর বাক্যের ধর্ম এবং ধর্মহীনতা যিনি জানেন না, তাঁকে শুধু অদ্ভুত আর আঁকাবাঁকা কিছু লালিত্যপূর্ণ কথা বলার জন্য কবির মর্যাদা দেওয়া যায় না। তিনি যে কবি হতে বদ্ধপরিকর, কবিতাকে যে যিনি সমাজে মই হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছেন, সেজন্যই শুধু তাঁর চমকপ্রদ উচ্চারণ কাউকে কবি হিসেবে আস্থাভাজন করবে না। না, এতক্ষণ আপনি ছাপার ভুল পড়ছিলেন না। এঁদের আমি সসম্মানে ‘কোবি’ বলে থাকি, এঁরা সেটা মুখের উপরে শুনেও zআনতি পারেন না। কবি আর কোবি, প্রায় একইরকম শুনতে লাগে বন্ধু।