আমাদের একটিই চুমুর স্মৃতি
লসএ্যাঞ্জেলস
শহর। আমেরিকার বাংলা টাউন। বাঙালিদের বসবাসের জন্য খ্যাত। রাহাত এখানে একটি আইটি
কোম্পানিতে জব করছে প্রায় পাঁচ বছর। বিয়ে করেনি এখনও। দেশে ফেরার কোনো
তাড়াহুড়ো নেই। বাবা-মা বেঁচে নেই।
একজন বড় বোন রয়েছে। যিনি ইডেন থেকে মাস্টার্স শেষ করেছেন ইকোনমিক্সে। বিয়ে করে
সংসার করছেন। ঢাকায় স্থায়ী বসবাস। আর্থিক সচ্ছলতা থাকলেও একটা বাচ্চাদের স্কুলে
শিক্ষকতা করেন সময় কাটানো ও ব্যস্ত থাকার জন্য। বাবা-মায়ের অবর্তমানে অভিভাবক হিসেবে একমাত্র ভাইকে বিয়ে করে
সংসারী হতে বলেন প্রায়ই।
বাবা-মা মারা যাবার
পর যশোরের বেজপাড়া এলাকায় রাহাতদের তিন বিঘের বাড়িটা পতিত পড়ে ছিল দীর্ঘদিন। বেজপাড়ায়
শেখ হাসিনা সফটওয়্যার পার্ক নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ হলে বাড়িটি সরকারের কাজে
লাগে। বিনিময়ে যা টাকা পায় তার কিছু অংশ দিয়ে আমেরিকা যায় রাহাত। এরপর আর নতুন করে
বাড়িঘর নির্মাণ করে স্থায়ী আবাসন তৈরি করেনি রাহাত। ফলে স্থায়ী ঠিকানাবিহীন হয়ে আর দেশে আসা হয়নি রাহাতের।
এরপর পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে। বোনের পীড়াপীড়িতে এবার দেশে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে
রাহাত। দেশে মেয়ে দেখা হচ্ছে। রাহাতের এতে কোনো আগ্রহ নেই। বোনের পছন্দের পাত্রী
বিয়ে করবে। নিজস্ব কোনো পছন্দ-অপছন্দ নেই। দেশে ফেরা বা বিয়ে উপলক্ষ্যে অগ্রিম ছুটি
নেওয়ার জন্য অফিসে দরখাস্ত করেছে রাহাত। তিনমাসের ছুটি পাবে মার্চের মাঝামাঝি
থেকে।
রাহাতের জন্মস্থান ও বেড়ে ওঠা যশোরে। শৈশবস্মৃতির শহর যশোরে স্থায়ী আবাসন
হিসেবে বাড়ি করবার ইচ্ছে রয়েছে। ক্যান্টনমেন্ট এলাকা পছন্দ রাহাতের। বিয়ের পাত্রী
পছন্দ করতে যশোরের মেয়েকে প্রাধান্য দিতে বলে রেখেছে রাহাত ওর আপুকে। আপু নীতু
নামের একটি মেয়েকে ভাইয়ের বউ হিসেবে পছন্দও করেছেন। সাদামাটা একটা মেয়ে। ফর্সা-কালোর মাঝে মোটাসোটা একটা শরীর। মাঝারি-লম্বা গড়ন নীতুর। ক্যান্টনমেন্ট কলেজের পদার্থের লেকচারার। বয়স ২৯
বছর ৬ মাস ২৭ দিন জন্মসনদ অনুযায়ী। রাহাতের লম্বা গড়নের চিকন শরীরের ৯ মার্কা
চেহারার তুলনায় মেয়েটির শারীরিক সামর্থ্য, সৌন্দর্য ভালো অবশ্যই।
দুই পরিবারের পছন্দ মিলে যাওয়ায় আংটি পরানো হয়েছে। রাহাত দেশে আসলে বাকি
ফর্মালিটিজ মেইন্টেইন করা হবে। মেইলে রাহাতকে ছবি পাঠানো হল নীতুর। ছবি দেখে রাহাত
থ!
বিস্ময়ে ওর চোখ বড় হয়ে মণিগুলো কুঠুরি
হতে ঠিকরে বের হবার উপক্রম হলো। মনে পড়ে গেল ছাত্রজীবনের কিছু সুন্দর স্মৃতি।
এম. এম. কলেজ, যশোর। ২০০৮ সালের কথা। অনার্সে ভর্তি হতে আসল নীতু। রাহাত
তখন সেকেন্ড ইয়ারে। ছবি ও সার্টিফিকেট সত্যায়িত করা হয়নি নীতুর। ভর্তির লাস্ট ডেট।
নীতুর কী করা উচিত, কিভাবে কী করবে
বুঝে উঠতে পারছিল না। সাথে পরিবারের কেউ নেই। সেইদিন নীতুর কাগজপত্রে সত্যায়িত সিল
মেরে নিজেই স্বাক্ষর করে কলেজের অফিসে জমা দিয়ে দেয় রাহাত। বেশিরভাগ সত্যায়িত যে
এভাবেই ভুয়া হয়ে থাকে তা নীতুর বিশ্বাসই হচ্ছিল না। রাহাত তখন বিএনসিসির সদস্য।
নীতুকেও সদস্য হবার অনুরোধ জানায় প্রথম পরিচয়ে।
ক্লাস শুরু হলে মাঝেমধ্যে হাই-হ্যালো, দেখা-কথা হত। এরপর বিএনসিসি ও বিবর্তন সংগঠনের মাধ্যমে কবিতা নিয়ে আড্ডা
এবং রক্তদান কর্মসূচিসহ নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিজেদের পরিচয় বন্ধুত্ব
গাঢ় রূপ নেয় রাহাত-নীতুর। নীতু বা
রাহাত কেউ ভালো আবৃত্তি করে না। ভালোলাগা থেকে কবিতাচর্চা করে। ক্যাম্পাসের বাইরেও নিজেদের প্রয়োজন-অপ্রয়োজন শেয়ার করে বিশ্বস্ততায়।
অনার্সের শেষদিকে রাহাতের বোনের বিয়ে হয়। কিছুদিন পর রাহাতের মা-বাবা রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান। এসময় রাহাত খুব একা হয়ে
পড়লে নীতু মানসিক সাপোর্ট দেয়, সময় দেয়, সঙ্গ দেয়। অন্য সাবজেক্টের স্টুডেন্ট হয়েও বেশ কষ্ট করে
রাহাতের ফাইনাল পরীক্ষার যাবতীয় নোট সংগ্রহ করে সাজিয়ে গুছিয়ে দেয় নীতু। এভাবে
চলার কারণে নীতুর উপর ডিপেন্ডেন্ট হয়ে পড়ে রাহাত। তীব্র ভালোবাসা তৈরি হয়। বন্ধুর
চেয়ে আরও আপন ও বিশেষ কেউ মনে হয় নীতুকে। কিন্তু নীতুর দিক থেকে কখনও বন্ধুত্বের
বেশি কোনো ইঙ্গিত পায়নি রাহাত। তাই বন্ধুত্ব নষ্ট হবার ভয়ে রাহাত আগ বাড়িয়ে মুখে
কিছু বলত না। তবে মেয়েদের সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত ঐশ্বরিক ক্ষমতা রয়েছে। সেই ক্ষমতাবলে
নীতু যে সব বুঝেও সাড়া দিত না, এটা ভেবেই রাহাত নেগেটিভ রেজাল্ট ধরে নিয়েছিল। নিশ্চয় নীতু তাকে পছন্দ করে না। সরাসরি এ নিয়ে কখনও আলাপ
হয়নি ওদের। বিপরীত লিঙ্গের বন্ধুত্ব খুব দুর্লভ, যা শুধুই বন্ধুত্বে সীমাবদ্ধ।
মাস্টার্সে যশোর ছেড়ে ঢাকা কলেজে ভর্তি হয় রাহাত। সাবসিডিয়ারি আইসিটিতে পড়বার
সুযোগ পায়। আইসিটি নামমাত্র! ক্লাস গজামার্কা আর শিখেছেও অষ্টকলা। তবু একটা অতিরিক্ত
সার্টিফিকেট পায় এই যা। অবশ্য এ কোর্সের কারণেই নিজস্ব প্রচেষ্টায় আইটিতে দক্ষ হয়ে
ওঠে রাহাত। আর সেটাই রুটিরুজির বাহক হয়ে যায় কিছুদিন পর। মানুষ যা হতে চায় তা আসলে
নিরানব্বই ভাগ মানুষই ভুলে যায়। আর-একজনের চাওয়া বা প্রয়োজন মেটাতেই হয়তো একসময়
বেঁচে থাকা অর্থবহ হয়ে ওঠে।
মাস্টার্স চলাকালীন ও বাড়ি বিক্রির সময়ে কয়েকবার দেখা হয় ওদের। আমেরিকা যাওয়ার
পর থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় প্রযুক্তির এ সময়েও। রাহাত আসলে প্রয়োজন ফুরিয়ে
যাবার আগেই নিজেকে গুটিয়ে নেয়। নীতু শুধু হ্যাঁতে হ্যাঁ মিলিয়ে যোগাযোগের চেষ্টাটা
করেনি। হয়তো রাহাতের আগ্রহের ভাটার কারণেও সেটা হতে পারে।
লসএ্যাঞ্জেলস যাওয়ার সুযোগ পেয়ে রাহাতের জন্য শারীরিক দূরত্ব বাড়ানোটা আরও সহজ
হয়। ভালোবাসার মানুষ বুকের বামপাশে হার্টবিটের মতো বসবাস করে। তাকে চাইলেই কেউ
সরিয়ে রাখতে পারবে না। প্রেমিকেরা সে চেষ্টা করে না। তবে শারীরিক দূরত্ব বাড়িয়ে তারা
মানসিক প্রশান্তি খোঁজে।
রাহাতের ভালোলাগা, ভালোবাসার
নির্মোহ এই বিচ্ছিন্নতার প্রচেষ্টা দীর্ঘ পাঁচ বছর সফল ছিল। কিন্তু নীতুর
ছবি দেখবার পর সব এলোমেলো হয়ে যায়। কথা বলতে ইচ্ছে করে। ভীষণ রকম টান অনুভব করে।
কিন্তু দীর্ঘ বছরের দূরত্বে কথা না বলার রেওয়াজ ভেঙে প্রাথমিক শুরুটা করতে কোথায়
যেন বাধা পায়, আটকে যায়। দমে
যায় কথা বলার অদম্য স্পৃহা। দীর্ঘ বিরতিতে কথা বলবার সবথেকে প্রিয় মানুষটির সাথে
কথা না বলাই যৌক্তিক হয়ে ওঠে। অথচ কথা জমে জমে পাহাড়সম হয়ে আছে। ঠিক যেন কোনটা
দিয়ে শুরু করা যায় সেটাই বাছাই করতে না পারা। কিন্তু একবার শুরু হলে হয়তো দীর্ঘ রাতদিন
বুকে জড়িয়ে সব না বলা কথা নির্বাক বলে দেওয়া যাবে। কিন্তু রাহাত বলতে পারে না, শুরুটাও হয়ে ওঠে না। আর নীতুর মধ্যে কী হচ্ছিল রাহাত তা
জানে না। বুঝতে চেষ্টা করলে নেগেটিভ এসে ভিড় করে বলে ভাবতে চায় না।
বিয়ের কথা পাকা হয়েছে, নীতুকে আংটি পরানো হয়েছে। কিন্তু নীতু কি এ বিয়েতে রাহাতকে
জেনে বা ছবি দেখে মত দিয়েছে? নাকি পরিবারের চাওয়াতে মত দিয়েছে? ওর নিজের কি কেউ পছন্দের নেই? রাহাতের মনে নানান চিন্তা এসে ভিড় করে। অফিস ছুটির চূড়ান্ত
অনুমোদনের অপেক্ষা করে রাহাত। বিয়ের আগে অন্তত নীতুর সাথে সরাসরি দেখা করতে চায়, কথা বলতে চায়। সব প্রশ্নের মীমাংসা চায় কিন্তু সেটা ফেসবুক, হোয়াটসআ্যপ বা ফোনে কথা বলে নয়। রাহাত সরাসরি দেখা করতে
চায় প্রিয় নীতুর সাথে।
মার্চের ১৪ তারিখ থেকে ছুটি পাশ হয় রাহাতের। তিনমাসের ছুটি। এরমধ্যে বিয়েসহ
যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে হবে। এখনও একমাস বাকি ছুটি শুরু হতে। অথচ এখনই একটা
আনন্দের হিল্লোল বয়ে যাচ্ছে রাহাতের মনে। আবার প্রশ্নবাণে জর্জরিত হচ্ছে সংশয়ের
দোলাচলে।
বিভিন্ন প্রশ্ন ও সংশয়ের মধ্যে কেটে গেল কিছুদিন। শুরু হল একবিংশ শতাব্দীর
ভয়াবহ বছর। মহামারীতে রূপ নিল করোনা ভাইরাস কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব। স্তিমিত হয়ে পড়ল সারা বিশ্ব। লকডাউন
নামে ঘরে বন্দি হলো চীন, ইতালিসহ আক্রান্ত দেশের মানুষ। এই দুঃসময় মাথায় নিয়ে দেশে
ফিরল রাহাত। বোনের বাসায় উঠল। উত্তরা নয় নম্বর সেক্টর। স্নিগ্ধা ভিলার চার নম্বর ফ্লোরের
ফ্ল্যাটে। ১৪ মার্চ থেকে ১৪ দিন থাকবে হোম কোয়ারেন্টাইনে। যদিও প্রেসিডেন্ট
ট্রাম্প বুড়ো আঙুল দেখিয়েছিল, কিচ্ছু হবে না! কিন্তু করোনা ট্রাম্প চেনে না! তাই সতর্ক থাকা। বোনের পরিবারকে নিরাপদ রাখার চেষ্টা।
৮ মার্চে বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী সনাক্ত হয়েছে। এর পুরোভাগ ক্রেডিট বিদেশ ফেরত
মানুষের। বিমান বন্দরে পরীক্ষার যন্ত্র থাকলেও সেই যন্ত্র চালাবার চালক নেই কিংবা
যন্ত্রের কার্যকারিতা নেই! আবার ৫০০ টাকায় করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেটও পাওয়া যায় এখানে! হোম কোয়ারেন্টাইন শেষ হলে যশোর যাবার সিদ্ধান্ত নেয় রাহাত।
যদিও নীতুর অ্যাড্রেস জানে না রাহাত তবে আপুর থেকে জেনে নেওয়া যাবে। তাছাড়া
ক্যান্টনমেন্ট কলেজ তো চেনেই। পদার্থ বিজ্ঞানের লেকচারারকে খুঁজে পেতে খুব একটা
অসুবিধা হবে না।
কোয়ারেন্টাইনের দিনগুলো খুব বোরিং কাটে রাহাতের। আপু এটা-ওটা রান্না করে রুমের
দরজার পাশে রাখে। রাহাত দরজা খুলে খাবার রুমে নিয়ে প্রয়োজনমতো খায়, ফ্রিজিং করে। খাবার পর বালিসে মাথা রেখে আয়েশি ভঙ্গিতে
ঝিমোয়। প্রথম দেখায় নীতুকে কী কী বলবে সেসব ভেবে ভেবে ঠিক করে। কিছুক্ষণ পরে
সেগুলে বাদ দিয়ে নতুন করে ভাবে। কিছুই গুছিয়ে উঠতে পারে না। এভাবে আরও কয়েকদিন
কেটে যায়।
প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন, স্কুল-কলেজের পর বিশ্ববিদ্যালয়ও বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বিরোধী
দলের নেতার মুক্তি, দীর্ঘ সাজাভোগ
করা কয়েদিদের মুক্তিসহ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের উৎসব এবং ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের
অনুষ্ঠান না করার সিদ্ধান্ত নেয় রাষ্ট্র। লোকসমাগম নিষিদ্ধ করাসহ সার্বিক বিবেচনায়
সমগ্র দেশ লকডাউনে যেতে বাধ্য হয়। ২৫ মার্চ থেকে সমগ্র দেশের সাথে ঢাকা শহরের সব
ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। রেল, সড়ক, নৌচলাচল বিচ্ছিন্ন করা হয় অনির্দিষ্টকালের জন্য।
সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হয় যেন কোভিড-১৯ ভাইরাসটি ছড়াতে না পারে মাসপিপলের মধ্যে। পুলিশকে
সর্বোচ্চটা দিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখা গেল। পুলিশ যে জনগণের বন্ধু সেটা
প্রমাণিত হল এই দুর্যোগের শুরুর দিকে। কিন্তু সাধারণের মধ্যে লকডাউনের, আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইনের মতো কঠিন পরিভাষাগুলোর গুরুত্ব
বোঝানো গেল না। তারা চোর-পুলিশ খেলায় নামল মনে হয়। গলির মোড়ের দোকান থেকে বাজারের
ভিড় কমল না। সাধারণের বোধহয় কারফিউ বা ১৪৪ ধারার ব্যাপারেই শুধু জানাশোনা! সত্য যে, বাঙালি একমাত্র লাঠির ভাষা সহজে বোঝে— আবারও তারা বীরদর্পে
প্রমাণ করল।
ভাবনায় ডুবে, খবরের কাগজ পড়ে
আর টকশো শুনে দিন কাটছিল রাহাতের। বিশেষ বিশেষ টিভির টকশো দেখলে কমেডি, হাতাহাতি, ঝগড়াসহ থ্রিলার সাসপেন্সের মতো ফিল একসাথে পাওয়া যায়। আর
সঞ্চালকের জ্ঞানগর্ভ অবিচক্ষণতার কথা নাই বা বলা যাক। এই অভিজ্ঞতা রাহাতের দেশে
এসে নতুন ভাবে হল। এসব বিষয় থেকে মনকে ডাইভার্ট করতে জানালায় দাঁড়ায় রাহাত।
বাইরে তাকালে চোখে পড়ে মানুষের হেঁটে চলা। মুখোশ পরা মানুষ! রিকশা ভর্তি বাজারের বহর নিয়ে বাসার দিকে যাচ্ছে অনেকেই।
অথচ এভাবে চললে কৃত্রিম সংকট তৈরি হবে, দাম বাড়বে স্বাভাবিকভাবেই। অবশ্য বাজার তদারকি হচ্ছে
ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে। যেন কেউ দাম বেশি রাখতে না পারে। তবু পাঁচ টাকার
মাস্ক পঞ্চাশ হল।
হ্যান্ড স্যানিটাইজার চল্লিশ টাকারটা
দুশো টাকায়ও বিক্রি হল কোথাও।
এই যে দুর্যোগ শুরু হল, রাহাত ভাবল এই তো কেটে যাবে। এই তো সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু
লকডাউনের মেয়াদ বেড়েই চলল।
একইভাবে আক্রান্তের সংখ্যাও। রাহাতের
যশোর যাওয়ার অপেক্ষাও বাড়ল। অপেক্ষার সময় এমনিতেই দীর্ঘ হয়। আর সেটা যদি বসে-শুয়ে নিতান্ত অলস কাটাতে হয়, তাহলে তা আরও দীর্ঘ হবে ভাবা বাহুল্য। সরকারি অফিস, বেসরকারি অফিস, গারমেন্টসসহ অন্য অফিস-আদালত বন্ধ রয়েছে। উৎপাদন বন্ধ হলেও
খাবারের চাহিদা তো আটকে রাখা যায় না। ক্ষুধা কোনো ধর্ম মানে না। তার চায় নিবারণের
উৎস। জনবহুল দেশের লোকদের কর্মহীন রাখা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। জনসংখ্যা সহজেই দ্বিগুণ
হবার সম্ভাবনাও থাকে! চীন, ইতালি ও আমেরিকাতে করোনা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।
প্রতিদিন কয়েক হাজার করে মানুষ ভাইরাসের কারণে মারা যাচ্ছে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশই
আক্রান্ত হয়েছে ভাইরাসটির বিস্তারে। বাতাসের মাধ্যমে রোগটি মহামারি ছাড়িয়ে
অতিমারিতে রূপান্তরিত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এর সহজ ও দ্রুত কোনো নিরাময় নেই। এটাও ভাবাচ্ছে সবাইকে। রোগটি বিস্তারের কারণ অনুসন্ধানে
কোনো সোর্স খুঁজে পাচ্ছে না বিজ্ঞানীরা। কোনো প্রতিষেধক নেই। সহজে আবিষ্কারের
সম্ভাবনাও দেখাচ্ছে না কেউ। প্রতিদিন অসংখ্যবার হাত ধুয়ে ধুয়ে হাতের উপরের চামড়া
পাতলা হয়ে যাচ্ছে মানুষের।
লকডাউনের মধ্যেই পহেলা বৈশাখ পার হয়ে গেল। পহেলা বৈশাখে রমনা পার্ক কিংবা
দেশের অন্য কোথাও কোনো অনুষ্ঠান হল না। ঘরে বসে বৈশাখী সাজের আবহে সাজানো মঞ্চে
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণটা দেখা ও শোনা গেল মাত্র। দীর্ঘদিন দেশে রাষ্ট্রপতির কোনো
বাণী নেই। স্বাভাবিক স্বভাবসুলভ রসিকতা নেই। সদানন্দের এই মানুষটাও বোধহয় বিরস হয়ে
পড়েছেন। ভাবছে রাহাত। ভাবা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই রাহাতের।
গরিবদের মধ্যে এখন আর নিয়মের তোয়াক্কা করতে দেখা যাচ্ছে না। পেটে খেলে পিঠে
সয়। এখন তো পেটই খালি। ত্রাণের চাল-ডাল তাদের পর্যন্ত সব পৌঁছাচ্ছে না। ইতোমধ্যে স্থানীয়
নির্বাচিত কয়েকজন চালচোর প্রতিনিধিকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। আর্মি মাঠ পর্যায়ে
জণগনকে সচেতন করছে। বেশিরভাগ ডাক্তার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। যদিও তাঁরা
করোনার সর্বোচ্চ প্রোটেকশান নিয়ে কাজ করছেন বলা যায় না। ডাক্তার, নার্স— এর মধ্যে অনেকেই করোনা আক্রান্ত হয়েছেন।
২৫ এপ্রিল রমজান মাস শুরু হল। প্রতিবার রাহাত কয়েকটি রোজা রাখে। এবার ঘরে বসে নামাজ ও
রোজার প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়েছে। সবগুলো রোজা রাখবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভয়
মানুষের মধ্যে ধর্মীয়বোধ তৈরিতে ভূমিকা রাখে। দশজনের বেশি মসজিদে সালাত আদায় করতে পারবে না—
সরকারিভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অথচ
লক্ষাধিক মানুষ জানাজায় অংশ নিয়ে বিপদের মধ্যে পড়ার বোকামি করেছে দেশের একটি
ঐতিহ্যবাহী জেলায়। ধর্মীয় কুসংস্কার আফিমের মতো। আসক্ত হয়ে গেলে আফিমই শান্ত রাখে
বিধায় রাষ্ট্র তাল মিলিয়ে চলতে চেষ্টা করে বোধহয়! কয়েকটি রোজা হয়ে গেল। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বিশ্বাস ভুল
প্রমাণ করে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে গেল। মৃতের সংখ্যা
বাড়তে থাকল।
এরই মধ্যে ১৫ মে আসি আসি করছে। নীতুর জন্মদিন। রাহাত সিদ্ধান্ত নিল নীতুকে
সারপ্রাইজ দিয়ে দেখা করবে ১৫ মে। দেশে এসে ঢাকায় অবস্থান করেও রাহাত কোনো যোগাযোগ
করেনি নীতুর সাথে। সারপ্রাইজ দিবে বলে অপেক্ষা করে আছে শহরের ছোট্ট ফ্ল্যাটে। জীবন
রসহীন, বিস্বাদ হয়ে
উঠেছে। বদ্ধ ঘরে বিষাদ ছড়িয়ে যাচ্ছে চাঁদের মতো একাকী অথচ স্বপ্নময় সময় কাটিয়েও।
এভাবে আর কতদিন কাটাতে হবে কেউ জানে না। প্রকৃতি বিরূপ হয়ে উঠেছে। নিজেকে সারমেয়
করে তুলেছে। প্রকৃতিও সারভাইব করতে চেষ্টা করছে নিজস্ব চেষ্টায়। সম্ভাবনাময়ী পৃথিবী
অকালপ্রয়াত হতে চায় না।
পরিস্থিতি বিরূপ হলেও রাহাত সিদ্ধান্ত নেয় ১৫ মে সশরীরে হাজির হবে নীতুর
সামনে। ভালোবাসি বলবে। বিয়েতে নীতুর সম্মতি আছে কী-না জানতে চাইবে। নীতু নামের প্রতি যে অদ্ভুত টান রয়েছে
রাহাতের তা নীতুর অজানা নয়। সে টান এখনও একইভাবে রয়েছে। না পাওয়া বিষয়ের প্রতি
মানুষের আকর্ষণ অদম্য। সহজে যা পাওয়া যায় তার গুরুত্ব কেউ স্বীকার করে না। তার
মূল্যায়ন সবাই করতে পারে না।
১৪ মে রাত এগারোটার দিকে প্রাইভেট কার চালিয়ে যশোরের উদ্দ্যেশ্যে রওনা হলো
রাহাত। নিজের আন্তর্জাতিক ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে। দুলাভাই গাড়ির কাগজপত্র ঠিকঠাক
রেখেছেন। তাই বিশেষ সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে বলে মনে হয় না রাহাতের। তাছাড়া পদ্মা
নদীতে ফেরি পার হতে বিশেষ কোনো অসুবিধা নেই। সময়ে মানুষের কাছে ঘোর বিপদও
স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। সময়ই সর্বোত্তম প্রতিষেধক দিয়ে থাকে। করোনাকালীন এ সময়ে
প্রতিদিন এক হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, গড়ে কুড়িজনের বেশি মারা যাচ্ছে। সামনে হয়তো প্রতিদিন বিশ
হাজার আক্রান্ত হবে, একহাজার জন মারা
যাবে। তবু প্রশাসনিক কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে, ব্যাংক, বাজার, গারমেন্টস খোলা আছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য বাইরে
যেতে হচ্ছে। হাসপাতালে হার্টের রোগী ভর্তি হয়ে করোনা পজিটিভ হয়ে বাসায় ফিরে যাচ্ছে! তবু সাধারণ মানুষ মৃত্যু উপেক্ষা করে বাইরে আনন্দচিত্তে
মৃত্যুমিছিল করছে, কেউ করতে বাধ্য
হচ্ছে।
রাহাত ফেরিঘাটে পৌঁছল রাত দেড়টার সময়। বৈরী আবহাওয়ার কারণে রাতে ফেরি চলাচল
বন্ধ থাকায় পদ্মা-যমুনার গোয়ালন্দ
পার হতে পারল না। সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল। সকাল সাতটার পর
ফেরি চলাচল শুরু হলে ঘাট পার হল রাহাত। নয়টায় দিকে মাগুরা সৈকত হোটেলের সামনে গাড়ি
থামিয়ে রাতের সমস্ত ক্লান্তি থেকে সতেজ হতে হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা করল। আজ আর রোজা
রাখেনি রাহাত। শরীরটা দুর্বল হয়ে পড়েছে নির্ঘুম রাত কাটানোর জন্য।
সাড়ে দশটার সময় যশোর শহরে ঢোকার আগে চেকপোস্টে থামতে হল রাহাতকে। ঢাকা বা
বাইরের যে কোনো জেলা থেকে লোক আসলে তাদের তাপমাত্রা পরীক্ষা করে শহরে ঢোকার অনুমতি
দেওয়া হচ্ছে। বিধি বাম! রাহাত অনুমতি
পেল না। শরীরের তাপমাত্রা বেশি। রাহাতকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে করোনা
টেস্টের জন্য যেতে হল। টেস্ট করার পর একটি আইসোলেশন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হল। পরীক্ষার
রিপোর্ট হাতে পেতে একদিন সময় লাগবে। সেই পর্যন্ত এখানে থাকতে হবে। গাড়ির মধ্যে
ত্রিশটি টকটকে লাল গোলাপের সুবাস শুকিয়ে ম্রিয়মাণ হচ্ছে। নীতুর সাথে দেখা করার
অপেক্ষা দীর্ঘ হচ্ছে। এক শহরে থেকেও কিছু করার উপায় নেই। আনন্দ-মুহূর্তের জন্য অপেক্ষার সময় দীর্ঘ হয় পৃথিবীতে। পাওয়ার
জন্য যে ভ্রমণ তা সহজ হয় না কখনোই। সবাই শুধু অর্জনটুকু দেখে, সে অর্জনের জন্য যে ভ্রমণ, তার খবর কেউ কোনোদিন নিতে আসে না।
পরেরদিন দুপুরের পর রিপোর্ট আসল। রাহাতের করোনা নেগেটিভ। ছাড়া পেল আইসোলেশন সেন্টার থেকে। গাড়ি
নিয়ে ছুটে গেল ক্যান্টনমেন্ট কলেজে। কলেজ বন্ধ। একজন পিয়নকে পেল। তার মাধ্যমে
ফিজিক্সের একজন ম্যাডামের নম্বর পেল। এই ম্যাডামের মাধ্যমে নীতুর খোঁজ পেল রাহাত।
পাওয়া গেল বাসার ঠিকানা। রাহাত চাইলেই আপুর থেকে নম্বর বা ঠিকানা নিতে পারত। সহজ বিষয়টিকে
একটু কঠিন করে পেতে চলল রাহাত।
নীতুর নম্বর পেলেও ফোন দিল না। সোজা বাসার ঠিকানায় চলে গেল। চাররুমের ফ্ল্যাট
আকারে তৈরি বাংলো টাইপের দুইতলা ভবন। বাড়িটা বেশিদিন আগের তৈরি নয়। তিন-চার বছর হবে হয়তো। গেটের সামনে একটি লিচু গাছে পাকা থোকা
থোকা লিচু ঝুলছে। নীতুর বাবা সরকারি চাকরি থেকে রিটায়ার করার পর জমি কিনে ছোট্ট এ
বাড়িটি তৈরি করেছেন। দুইতলায় থাকে নীতুরা। কলিংবেল চাপবার সময় বুকটা দুরুদুরু করে
কাঁপছে রাহাতের। ঘেমে যাচ্ছে অদ্ভুত আবেগে। ভুলে ফুলগুলোও গাড়ীতে ফেলে রেখে এসেছে।
তৃতীয়বার কলিংবেল বাজানোর পর নীতুই দরজা খুলল। সাদা রংয়ের
টিশার্ট পড়া, মাথার চুলগুলো
কিশোরীদের মতো দুটো বেণী করা। রাহাতকে দেখে দরজায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইল নীতু। কারও মুখে
কোনো কথা নেই। নেই কোনো বাক্যবিনিময়, আনুষ্ঠানিকতা কিংবা আবেগে চিৎকার করে ওঠা। ভাষাহীন দুটি
প্রাণ কতক্ষণ এভাবে কাটিয়েছে কেউ অনুমান করতে পারেনি। হয়তো তিন মিনিট, পাঁচ মিনিট বা আরও অধিক সময়। নীতু একসময় দরজা ছেড়ে ঘুরে
দাঁড়ালে রাহাত ফ্ল্যাটের ভেতরে এগিয়ে গেল। নীতুর রুম। হালকা নীল রঙের দেয়াল।
ড্রেসিং টেবিল, শোকেসে নীতুর
কিছু পুরস্কার সাজানো। দেয়ালে রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও আহমদ ছফার ছবি। বিছানায়
মাথার পাশের দেয়ালে রাহাত। মানে রাহাতের অনার্সে পড়ার সময় নীতুর সাথে তোলা একটা
সাদাকালো ছবি। একটু বড় করে ফ্রেমে সাজিয়ে টাঙানো। তার পাশে বিএনসিসি থেকে পাওয়া
রাহাতের একটি সম্মাননা সার্টিফিকেট নেওয়ার ছবি। একটু অবাক হয় রাহাত এ বাড়িতে তার
অবাধ যাতায়াত ও পরিচিতি আছে জেনে। এ পর্যন্ত কেউ কারও সাথে কথা বলেনি। বসতে বলবার
কথাও ভুলে গেছে নীতু।
নীতুর বাবা-মা ছেলের বাসায়
বেড়াতে গিয়েছিলেন। নীতুর বিয়ে উপলক্ষেই এ বেড়ানো। কিন্তু করোনার কারণে ফিরে আসা হয়নি তাঁদের। কাজের মেয়েটি আপাতত আসে না।
নীতু একাই বাড়িতে।
রাহাতের সামনে দীর্ঘসময় বসে থাকার কারণে
কিছুটা স্বাভাবিক হল। পিরিয়ড চলছে বলে নীতু ৬ দিন রোজা করছে না। নীতুর ধর্মীয়
রীতিপালনে উদাসীনতা ছিল। কিন্তু ইদানীং ও নামাজ, রোজার মতো ম্যান্ডেটরি ধর্মীয় রীতিপালনে অভ্যস্ত হয়েছে।
রাহাতও রোজা নেই জেনে ফ্রেশ হতে বাথরুমটা দেখিয়ে দিয়ে খাবারের টেবিল গোছালো। যা
রান্না করেছিল তাই দু’জন ভাগ করে খেল। অনার্সে পড়াকালীন এমন অনেকবার খেয়েছে।
রাহাতের জন্য প্রায়ই নীতু রান্না করে নিয়ে যেত। রাহাত একা খেতে চাইত না। তখন নীতুকেও
একটু ভাগ নিতে হত। রাহাত গাড়ি থেকে
গোলাপ ও হাতে তৈরি একটি জন্মদিনের কার্ড এনে নীতুকে দিল। কোনো প্রশ্ন করা হল না, কোনো কিছুই জানতে চাওয়া হল না। না বলা কথা হয়তো নীরবতার
ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে। তাই রাহাতের আর ওসব জানবার প্রতি আগ্রহ রইল না।
নীতুর থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকায় ফেরার সময় হল রাহাতের। শেষ সময়ে নীতু আর নিজেকে
আড়াল করতে পারল না। জড়িয়ে ধরল রাহাতকে। ঠোঁটে এক দীর্ঘ চুম্বনে নিজের ভালোবাসার
জানান দিল সামাজিক দূরত্বের কথা ভুলে। বুকের পরম উষ্ণতা ও চোখের জল মিলে একাকার
হয়ে তৈরি হল আনন্দ-অশ্রু। দীর্ঘ
অপেক্ষা ও তীব্র আকাঙ্ক্ষার জমা বরফে এ চুম্বন উষ্ণতা ছড়াল প্রগাঢ় ভালোবাসায়।
রাহাত ঢাকা
পৌঁছালো রাত দশটার দিকে। বাসায় ফিরে দীর্ঘ গোসল দিয়ে ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে
খেয়ে একটা দীর্ঘ ঘুমের কাছে নিজেকে সমর্পণ করল। ঘুম থেকে উঠল পরেরদিন সকাল দশটায়।
বিছানায় শুয়ে নীতুকে ফোন দিল। দীর্ঘ দিনের জমানো বরফ গলে কথার রাজবল্লম ছুটে চলল
মোবাইলের এপাশ থেকে ওপাশে কান পেতে থাকা মায়াহরিণীর দিকে। এভাবেই কেটে গেল আনন্দের
আতিশয্যে আরও কয়েকটি দিন। পাঁচদিন পর হালকা জ্বর হল রাহাতের। এর দু’দিন পর শরীর ও
গলা ব্যথা। জ্বরের তাপমাত্রা ১০১ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেল। সেদিন রাতে বমি শুরু হলে
বুঝতে বাকি রইলো না যে এটা করোনারই লক্ষণ।
১৬২৬৩ নম্বরে কল করে কথাও বললো রাহাত। অষ্টম
দিনের মাথায় ঢাকা মেডিকেলে করোনা পরীক্ষা করাতে যায় নিজেই গাড়ি চালিয়ে। পরিবারের
অন্যদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলছিল এ ক’দিন। টেস্ট করানোর পরদিন সরকারি অ্যাম্বুলেন্স এসে হাসপাতালে নিয়ে যায়
রাহাতকে। রাহাত দুর্বল হয়ে পড়েনি, তাই বাসায় থেকে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারত। কিন্তু পরিবারের
অন্য সদস্যদের কথা ও এলাকার মানুষের কথা চিন্তা করে হাসপাতালে যাওয়া সমীচীন মনে
করল।
আঠারো দিনের মাথায় সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরল রাহাত। কিন্তু বাসায়
ফিরেই জানতে পারল নীতুও করোনা পজিটিভ হয়ে খুলনা মেডিকেলে ভর্তি রয়েছে। এ ক’দিন কেউ
এ কথা রাহাতকে জানায়নি। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হল রাহাতের। সেদিন যদি রাহাত যশোর
না যেত! কিংবা দূরত্ব
বজায় রাখত! তাহলে এই দুঃসংবাদের
মুখোমুখি হয়তো হতে হত না।
পরদিন সকালে রাহাত খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। বোন ও দুলাভাই নিষেধ করলেও রাহাত
কারও কথা শোনেনি। তাছাড়া রাহাতের আপুও রাহাতকে খুব জোরালোভাবে আটকাল না। সত্যিটা
এই যে, রাহাতের বিদেশ
থাকাকালীন পাঁচটা বছর রাহাতের সমস্ত খবর নীতু এই বোনের থেকেই জানত। ফেসবুকে বন্ধুতালিকায়
ছিল দু’জন। কলেজজীবনে রাহাতকে নীতু পছন্দ করত কিংবা রাহাত যে নীতুকে পছন্দ করত আপু
সেটা জানতেন। তাছাড়া রাহাত-নীতুর বিয়ের বিষয়টিও আপু ও নীতুর মাধ্যমেই পারিবারিক রূপ
নেয়। নীতু যে রাহাতের কারণে করোনাক্রান্ত সেটাও আপুর আঁচ করতে অসুবিধা হয় না।
রাহাত যেহেতু করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সদ্য সুস্থ হয়েছে তাই এই ভাইরাস ও
রোগীর সাবধানতা বিষয়ে ও অবগত। রাহাতের আগ্রহ ও ভালোবাসার কারণে সব শর্তকে শিথিল
করে নীতুর সার্বক্ষণিক দেখাশোনা করার জন্য পেশাগত দক্ষতা না থাকলেও রাহাতকে পাশে
থাকার অনুমতি দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
নীতুর শ্বাসকষ্টের সামান্য সমস্যা আগেই ছিল ফলে এর প্রভাব পড়ে প্রথমেই
ফুসফুসে। মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হওয়ার ফলে অক্সিজেনের মাস্ক পরিয়েও শ্বাসকষ্ট
কমানো যাচ্ছে না কোনোভাবেই। শরীরে ইমিউনিটি পাওয়ারও কমে যাচ্ছে ক্রমে। ভেন্টিলেটরের
ব্যবস্থা করা জরুরি কিন্তু খুলনা মেডিকেলে পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটর নেই। আইসিইউ
অ্যাম্বুলেন্স হলে অন্য হাসপাতালে স্থানান্তর করা যায় কিন্তু সেটাও সম্ভব হচ্ছে
না। প্রতিবন্ধকতা ও অসহায়ত্ব ঘিরে ধরেছে সকলকে। চারদিকে হাহাকার।
রাহাতের শরীর করোনা যোদ্ধা হিসেবে অ্যান্টিবডি তৈরি করে নিয়েছে। বিষয়টি মাথায়
রেখে খুলনা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দেশের প্রথম করোনা রোগীর শরীরে রক্তের প্লাজমা
ট্রান্সপ্লান্টের মাধ্যমে নীতুর শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরির পরীক্ষামূলক চেষ্টা করে।
নীতুর জন্য, ওদের ভালোবাসার
জন্য সর্বান্তকরণে ডাক্তার, নার্সসহ অন্যরা নীতুর প্রাণরক্ষার্থে শেষ চেষ্টা অব্যাহত
রাখে।
করোনার ভয়ানক যন্ত্রণা নীতুকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। একবার পৃথিবীর শ্বাস নেওয়ার
সুযোগ যেন একটা নতুন প্রাণের সঞ্চার। আবার শ্বাস ছাড়তে যেন কেড়ে নিচ্ছে সে প্রাণ। এ দৃশ্য
সহ্যক্ষমতার বাইরে। খুব প্রিয়জনের মৃত্যুও মাঝেমধ্যে কাছের মানুষদের কামনা করতে
হয়। এতেই প্রকৃত মুক্তি!
পরদিন দুপুরে রাহাতের চোখে চোখ রেখে পৃথিবীর শেষ অক্সিজেন গ্রহণ করে নীতু।
No comments:
Post a Comment