ভ্যান গঘের জন্মদিনে
বিষণ্ণ গমখেতের পাশে আমার কুঁড়েঘর৷
জানালায় শস্যের পর্দা সরালে দেখা যায়
মেঘে ঢাকা দূরের উপত্যকা।
তাকিয়ে থাকি— যদি মেঘ সরে যায়,
তবে ধরা দিবে একটি শাদা বাড়ি।
সেখানে বাস করে আশ্চর্য কিন্তু অশান্ত মেয়েটি,
যার ভালোবাসা আমারে রেখেছে শান্ত করে।
আহা, আশ্চর্য কিন্তু অশান্ত মেয়েটি,
তাঁর অস্থিরতা গমখেতে
জড়িয়ে পড়ে।
বিষণ্ণ...বিষণ্ণ...বিষণ্ণ বাতাসে ভেসে যাচ্ছি
ভেসে...ভেসে যাচ্ছি, ভ্যান গঘ!
মেঘের আড়ালে লুকানো দূরের উপত্যকায়
শান্ত বাড়িটিতে ঘুমিয়ে আছে অশান্ত মেয়েটি!
যখন ছড়াবে আতরের সুবাস
ঝালমরিচের দিন গেছে মিটে,
কে তোমারে মুখে তুলে দিবে ঝোল মাখা ভাত!
কুচি পিঁয়াজের মতো প্যাঁচানো হৃদয়ে তোমার
ফাঁপরে পড়ে গেছে যে দুপুর, সে
এখন রাত৷
আরো বয়স হলে তার, কে তোমারে শুনাবে
ছেঁড়া পৃষ্ঠা উল্টায়ে জীবনানন্দ দু'চার
লাইন!
কে'বা ছুটে যাবে, কারে'বা নিবে তুলে বুকে
আরো বিরহে জড়িয়ে ধরে কারে বলবে—
'হৃদি ভেসে গেলো অলকানন্দা জলে'!
তোমারে দিয়েছি ফাঁকা রাস্তা, বাইসাইকেল
দিন।
তোমারে দিয়েছি নয়নতারা, দিয়েছি কাঠগোলাপ।
তোমারে দিয়েছি কবিতার দৃশ্যাবলী, বিরহযাপন।
তোমারে দিয়েছি লেকের জলে বকুল ফুলের ঘ্রাণ।
তোমারে দিয়েছি নদী, নদীপাড়ে বটের ঝুড়ি।
তোমারে দিয়েছি চিল ওড়াউড়ি আকাশ।
আকাশের ক্ষেত্রতলে নদী পাড়ি দিয়ে
নাইওরে যাবা তুমি শাদা শাড়ি পরে
আমার শরীর ছড়াবে যখন আতরের সুবাস৷
পাহাড়ের বুকে
পাহাড়ি ঢলের শক্তি নিয়ে চলে গেছ,
মুছে দিয়ে ঝিরিপথের সমস্ত দিকচিহ্ন।
বিভ্রান্ত মানুষ এক — যেন আমি,
হারিয়ে ফেলেছি পাহাড়ে চড়ার পথ।
আশ্রয় যেটুকু ছিল — কোনো জুমঘর
উড়ে গেছে পলকা বাতাসে;
এখন ফেলেছি ক্যাম্প
বন্য ভাল্লুকের ক্ষুধার ভেতর৷
রাত ঘন হয়ে আসে — পাহাড়ের বুকে,
পাল্লা দিয়ে ঘন হয়ে নামে বৃষ্টি।
বর্ষণের সুর নয় — নয় ঝরণার গান,
পাহাড় ধ্বসের শব্দ শুনি। মনে হয়—
কারো কারো চলে যাওয়াটাই এমন,
স্থির পাহাড়ও হয়ে পড়ে অস্থির যেমন।
ভালোবাসবার পরে
হাঁটতে হাঁটতে দুনিয়া পার হইতে চাইতেছি।
দুনিয়া আটকায়া আছে সামান্য কয়েকটা গলিতে।
এই গলি থাইকা ওই গলি, ওই গলি থাইকা সেই গলি
আগাইতে পারি না বেশিদূর; আয়তাকারে
ঘুরতেছি।
অপ্রশস্ত গলির দুই ধারে সারি সারি গাছেদের প্রেম৷
গলি থাইকা গলির মধ্যবর্তী ফাঁকে সাজানো বাড়ি।
যেন এইসব বাড়ি পুরোনো মদের বোতল, টালমাটাল।
আমার পা দুইটা আরও টালমাটাল হয়া যায়।
তোমারে ভালোবাসবার পরে—
একটা টালমাটাল দুনিয়ায় আমি আটকায়া গেছি।
তারাবাতি
শৈশবের যে ঝোপঝাড়ে
সন্ধ্যা নামলেই তারাবাতির রূপ নিয়ে জোনাকিরা জ্বলে উঠতো, আব্বাকে
একদিন দেখেছিলাম সেই ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে চলে যেতে। বহুদিন হয়ে গেল— আব্বা ফিরেননি৷ আব্বা চলে যাবার পর শৈশবের সেই ঝোপঝাড়ে আর কোনো জোনাক
জ্বলতে দেখিনি। মাকে অবশ্য জিজ্ঞেস করেছিলাম— জোনাকগুলো
ক্যান জ্বলে না, আব্বাই'বা ক্যান আসে
না ফিরে! মা ঊর্ধ্বমুখে তাকিয়ে বলেছিলেন— আব্বা গেছেন
তারাবাতির দেশে।
আমি মায়ের মতোই
ঊর্ধ্বমুখে তাকাই। দেখি— অগণিত তারা জ্বলে আকাশে। ওই তারাদের দেশ থেকে
আব্বা নেমে আসবেন শৈশবের ঝোপঝাড়ে। আব্বা ফিরবেন, দু'হাত ভর্তি তারাবাতি নিয়ে আব্বা ফিরবেন৷ ঘরদোর, উঠোন,
পুকুরের ঘাট আলোকিত হয়ে উঠবেই৷
অপেক্ষায় থাকতে
থাকতে থাকতে থাকতে আমি অন্ধ হয়ে যাচ্ছি। আব্বা আজও ফিরেননি। আসলে আব্বারা চলে গেলে
প্রকৃত তারাবাতি নিভে যায়, জ্বলার আগেই।
No comments:
Post a Comment