ধারণাতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রথম গ্রিকরাই
পৃথিবীতে একথা জানিয়েছিলেন যে মানুষের জীবন হল এমন একটি পথ যার গতিবিধি মানুষকে নিজেকেই
করে যেতে হবে । জ্ঞান সেখানে একটি সাহায্যকারী অংশ, পাথেয় মাত্র । অর্জিত জ্ঞান ও বাধার থেকে নেওয়া
শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তি তার জীবনের পথ তৈরি করতে উদ্যত হবে । খাদ্যের জন্য লড়াই,
নিরাপত্তার জন্য লড়াই, লোভ, লালসা, আত্মত্যাগ, ঘৃণা,
পরোপকার করার ইচ্ছে, কিংবা রাষ্ট্রগঠনের
জন্য নেওয়া যেকোনও উদ্যোগই আসলে ব্যক্তিবোধের মধ্যে তৈরি হওয়া মানুষের জীবনের এক একটি
পথ । একটি নির্দিষ্ট কারণকে বাস্তবে প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যেই জন্ম হয় আইনের,
আবার তেমনই একটি কারণ, যা হয়ত নির্দিষ্ট
ব্যক্তির ক্ষেত্রে ন্যায় পরায়ণ, কিংবা ভুল দৃষ্টান্ত,
জগতের কাছে তাই-ই হল অপরাধ । এইভাবে বিবেচ্য
সিদ্ধান্ত এবং সেই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে পাল্টে যাওয়া বিচারবোধ দিয়ে গড়ে ওঠে সভ্যতার
মানসিকতা । সেই মানসিকতাই আমাদের সমস্ত অভ্যাস তৈরি করে । অপরদিকে একটি জাতি বা রাষ্ট্রের
সার্বিক মানসিকতা এক হলেও ব্যক্তিমানসিকতা ভিন্ন হতে পারে । ব্যক্তিমানসিকতার ভিন্নতা
জাতির মধ্যে কোনও মানুষকে অখণ্ডের ভিতর একটি পৃথক চরিত্রগঠন ও পরিচিতি এনে দিতে পারে
। তখন সে বাঁচার পাশাপাশি নিজের অস্তিত্বকে বড় করে বাঁচিয়ে রাখতে উদ্যত হয় । মানুষের
গভীরে, বহু অন্ধকার অচিনপথে সে ভাবনার যাত্রা শুরু করে,
এবং মানুষের ব্যক্তিমূল্যকে একটি জাতি, বা
বিশ্ব রাজনীতির সামনে তুলে আনে ।
গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, 'Humans are political animal.' অর্থাৎ, কোনও জৈবিক বা নৈতিক রাজনীতির সঙ্গে আমাদের
সত্তা অনন্তকাল থেকেই জড়িয়ে রয়েছে । ইউক্লিড জ্যামিতির দর্শনকে বোঝাতে গিয়ে মানুষে-মানুষে তৈরি হওয়া সম্পর্কের মধ্যে তৃতীয়পক্ষের অবস্থানকে গুরুত্ব দিয়েছেন
। সম্পর্কের মধ্যে তৃতীয়জন না এলে তৈরি হয় না কোণ, ভালোবাসা
চিরকাল সরলরেখায় পড়ে থাকে, ফলে জীবনের উঁচু স্থানগুলির বিপরীতে বিছিয়ে থাকা গভীরতার কোনও অনুসন্ধান
হয় না । সত্য নিজেই বিচিত্র, খণ্ডিত, পারস্পরিকভাবে অনতিক্রমযোগ্য, কাজেই সম্পূর্ণ সত্যজ্ঞান
চিরকালই কেবল অনুসন্ধানের পর্যায়ে থেকে যাবে । অপ্রত্যক্ষ ও অসীমের উদ্দেশ্যে যাত্রা
করাই হবে মানুষের প্রকৃত জ্ঞানচর্চার বিষয় ।
পার্থিব সকল বস্তু বিরোধীসত্তা বা পৃথক
নীতি কিংবা কোনও প্রতীয়মান অনুসন্ধানের সমন্বয়ে গঠিত । বস্তুর এই সকল অজানা দিক নিয়েই
ব্যক্তির যাবতীয় জীবন গড়ে ওঠে স্বীকার ও অস্বীকারের মাধ্যমে । আবার একাত্ব কিংবা বহুত্বের
মধ্যে দিয়ে একজন মানুষ নিজের দ্বিধার জীবন গড়ে তুলতে পারে । জগতে নীতি বা বিশ্লেষণের
উৎপত্তি, কিংবা
তাকে পেরিয়ে গিয়ে নীতিহীন কোনও নৈতিক ন্যায়, যা পরে গিয়ে সত্যে
পরিণত হবে, তা নিজেকে আবির্ভাব করেছে কোনও শিল্প কিংবা বিজ্ঞানের
মধ্যে দিয়ে, তার সবটাই হবে অস্তিত্ববাদী । অপরদিকে,
যে জ্ঞান মৌলিক, যা সময়ান্তরেও সমানভাবে
সত্য, তার অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও তা কোনওভাবেই পরিবর্তনশীল
নয় । পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে তা পুনরায় মানুষের জীবনে এসে পড়ে । শিল্পের মধ্যে সেই
মৌলিক জ্ঞান, অমীমাংশিত সত্য ভাবের আকারে থাকে, উপলব্ধির মধ্যে নিহিত অবস্থায় থাকে । সেই অনুভূতি, সেই অমীমাংশিত সত্যের মৃত্যু নেই বলেই প্রকৃত শিল্পের কোনও মৃত্যু নেই ।
আবার শিল্পী যখন কোনও একটি শিল্প নির্মাণ করছেন, আগে থাকতেই
তার অভ্যন্তরে এসে বাসা বাঁধে সেই শাশ্বত সত্য । একইভাবে মনে করা হয় ক্ষেত্রবিজ্ঞান
বা পরিমিতি হল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান ও সত্যানুসন্ধানের গগণা যা ধ্বংসশীল বিস্তৃতি
নিয়ে কোনও আলোচনা করে না । প্লেটোর দর্শনের মৌলনীতি তাই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞানকে ছাড়িয়ে
কিছুক্ষেত্রে গঠনমূলক নীতির দিকেও বিশ্লেষণকে নিয়ে গেছে । ভাবনা বা ধারণাও যেমন অস্বচ্ছ
সত্য, তেমন দৃশ্যমান যা কিছু, তাও
অাসলে অর্ধসত্য । সম্পূর্ণ ও অখণ্ড সত্য দৃষ্টিশক্তির বাইরে ঘটে চলে, সবার অলক্ষ্যে । সেই সত্য সম্পর্কে মানুষ কিছুই জানতে পারে না । মানুষ শুধু
অনুমানের ভিত্তিতে তার অস্তিত্বকে একটা ধারণার কাঠামো প্রদান করে তুলে আনে । সেই ধারণাই
বিচার করে মানুষের অপরাধ ও নিরাপরাধের ।
অপরাধ ও নিরাপরাধ হল পরস্পর বিরোধী
এক এমন সত্য যেখানে বহু মানুষই বিরুদ্ধমত গ্রহণ করে । সেখানে তারা মনে করে তারা যেটা
ভাবছে, সত্য হল
তাই । অপরপক্ষে যারা সহমত পোষণ করে, তারা ভাবে বিরুদ্ধমতাধিকারীরা
ভুল পথে হাঁটছে । সেই কারণে ন্যায় ও অন্যায়ের যাবতীয় সিদ্ধান্তই একইসঙ্গে অস্তিত্বশীল
ও অস্তিত্বহীন হতে পারে । আবার প্রত্যেক ব্যক্তির ন্যায় কিংবা অন্যায় যদি একইসঙ্গে
সত্য হয় বা সত্য না-হয়, তাহলে সমস্ত
ধারণাগুলোই প্রত্যেকের নিজের কাছে নির্ভুল বলে বিশ্বাসযোগ্য হবে । দর্শনের এই মৌলিক
সমস্যা সম্পর্কে গ্রিক দার্শনিক থেকে শুরু উত্তর আধুনিক সময়ের দার্শনিকেরা সকলেই প্রায়
জানেন । যারা হেরাক্লিটাসের দর্শনকে মেনে চলেছেন এবং পরবর্তীতে নিজেদের দার্শনিক মতবাদ
ও চিন্তাকে পৃথিবীর সামনে এনেছেন, তারা প্রত্যেকেই অপরিবর্তনশীল
অস্তিত্বকে সত্য বলে ধরে নিয়েছেন । কিন্তু জগতে এমনও কিছু অনির্দিষ্ট ও পরিবর্তনশীল
অস্তিত্ব আছে, যাকে সত্য বলে ধরে নিতে অস্বীকার করেছেন হেরাক্লিটাসের
অনুগামী দার্শনিকরা । দর্শনের মৌলিক নীতির প্রকৃতি তাই কখনওই সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার
করে না । জীবনে ঘটে চলা প্রতিটি ঘটনার নানান পার্শ্বীয় সত্য থাকে যার অনেকগুলিই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য
হয় না বলে আমরা তাকে অস্বীকার করি ।
দার্শনিকের মতো ভাবনা নিয়েই একজন বিরাট
কবির বা সাহিত্যিকের, কিংবা শিল্পীর জন্ম হয় পৃথিবীতে । কিন্তু তিনি সর্বদা তার রচনা,
শিল্পে, চিত্রে মানুষকে নিয়ে চলেন গন্তব্যহীন
এক দীর্ঘস্থায়ী যাত্রাতে । মানুষ সেই বিমূর্ত ভাবনাগুলোর পাশে নিজের চিন্তাশক্তিকে
নিয়োগ করে অথবা সেই ভাবনাগুলোকে এনে জড়ো করে তার জীবনের সমস্ত পরিস্থিতির মধ্যিখানে
। কাজেই বৃহত্তর অর্থে একজন শিল্পীকে বয়ে নিয়ে চলে সভ্যতা । সভ্যতার প্রয়োজন হয় তাঁকে
। লেখক বা কবি তাঁর রচিত যেকোনও বইয়ে অর্জিত মৌলিক দর্শনের কিছুটা অংশ রেখে যায় । রুশো
তাঁর 'সোশ্যাল কনট্রাক্ট' বইতে লিখেছেন,
'যে কারণে সার্বভৌমত্ব অবিচ্ছেদ্য, সেই কারণেই
সার্বভৌমত্ব অবিভাজ্য । সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে মানুষ তার জীবন, প্রচেষ্টা, সম্পদ, শক্তির
সবটাই রাষ্ট্রের প্রতি অর্পণ করে ।' যদিও দেখা যায় যে মানুষ
রাষ্ট্র থেকে নেওয়া নানা সুবিধার মধ্যে দিয়ে নিজের জন্য সুস্থ ও প্রতিষ্ঠিত একটা ভবিষ্যৎ
তৈরি করছে, তবু সে একজন প্রশিক্ষিত দাস হিসাবেই নিজেকে প্রস্তুত
করছে রাষ্ট্রের জন্য, যার উদ্দেশ্য হবে শ্রমের বিনিময় ও সামান্য
একটু শান্তিতে বাঁচার জন্য রাষ্ট্রের কাজের ভার গ্রহণ করা বা রাষ্ট্রকে আর্থিক কর প্রদানকারী
সংস্থার অধীনতা মেনে নেওয়া ।
ধারণার মধ্যে দিয়ে নির্মিত যে কোনও
শিল্পের অভ্যন্তরের কাঠামো হল এই । শিল্পের কোনও একটি বিশেষ ব্যাপারে আমরা যখন জড়িয়ে
পড়ি, তখন যে স্বার্থ
আমাদের পথ বেঁধে দেয় তা হল শিল্প সম্পর্কে বিতর্ক । বিতর্কের জন্ম হলেই আমাদের মধ্যে
এসে পড়ে বিভিন্নতা । একপক্ষ অন্যপক্ষের সত্যকে ভুল প্রমাণিত করে শিল্প সম্পর্কে তাদের
নিজস্বতাকেই শিল্পের স্বার্থ ও শিল্পের সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় । উল্টোদিকের
পক্ষ সেই প্রতিষ্ঠিত ভাবনাকে নস্যাৎ করে পৃথক যুক্তি তুলে ধরে । যেহেতু প্রকৃত সত্যে পৌঁছানো আমাদের
পক্ষে সম্ভব নয়, তাই বিতর্কের মধ্যে দিয়ে শিল্পের জীবনীশক্তি
আমরা ক্রমশ বাড়িয়ে তুলি । এই প্রবন্ধগুলো যখন এক এক করে পর্বভিত্তিকভাবে রচনা করছি
তখন প্রশ্ন আসে, এই লেখায় ছড়িয়ে থাকা ভাবনার একাধিক দিকের
শেষ কোথায় ? কেমন হবে এ রচনার সমাপ্তিপর্ব ? এ সকল প্রশ্নের উত্তর আপনা থেকেই আসবে, লেখার সত্য
সেই পরিণতি নিজে থেকেই নিয়ে আসবে । কিন্তু সেই সময় সম্পর্কে এখনই কিছু বলা যাবে না
। কারণ, জীবনের বিরুদ্ধে ও পক্ষে এখনও বলার মতো অনেক কথা আমার
অভ্যন্তরে পড়ে আছে । সেইসব কথার সত্য কি আসলে কেবল আমার নিজস্ব ধারণাই, না কি তা আসলে জীবনের কোনও এক সুনির্দিষ্ট পথ, যাকে অতিক্রম করতে চাইছে আমার ব্যক্তিবোধ, তার
বিচার আমার আগামী লেখাগুলোর মধ্যে দিয়েই প্রতিফলিত হবে ।
(ক্রমশ চলবে)
No comments:
Post a Comment