বাক্‌ ১৫১ ।। তমোঘ্ন মুখোপাধ্যায়

 


বৃত্ত

 

পৃথিবী-ভর্তি বাবাগুলো মরে গেলে আর যা পড়ে থাকবে

তাই দিয়ে এক বসন্ত টেনেটুনে পার করে দেওয়া সম্ভব।

কিন্তু তারপর তোমরাই ঘাড় নীচু করে হেঁড়ে গলায় বাবাদের

ফিরিয়ে আনার প্রায় অবাস্তব কথা বলবে, বলবে কীভাবে তাদের গা-ঘিনঘিনে

দিনাতিপাতের মধ্যেও রোদ ছিল, ফুল ছিল, হাসিখুশি কুকুর ছিল, 

ছিল বইপত্র আর একঘেয়ে গান কিংবা খবরের আশনাই, 

এদিকে তোমরা সেসবের কিছুই তৈরি করতে পারছ না। শুধু

মা-ধরনের যে-কোনও মহিলাই বলা নেই কওয়া নেই গর্ভবতী হয়ে যাচ্ছে।

তাদের দেখভাল করার জন্য আয়া রাখবার টাকা অব্দি নেই! 

 

জুয়া খেলতে খেলতে ওই যে তোমরা এ-ওর কানে ফিসফিস করেছ

কার বাবা বিয়ের আগেও কী স্বাভাবিকভাবে মেয়েদের কব্জির দিকে

তাকাতে পারত, বিয়ের পর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কীভাবে

শুধু খালি গায়ের লোমশ কর্তাভজা পুরুষ দেখে ঠোঁট কামড়ায়,

ইদানীং সেই গল্পে কেউ আর খিকখিক করে হেসে উঠছে না। 

যে যার নীচের ঠোঁট আড়াল করার চেষ্টায় বাতুলের মতো চিৎকার করছে

সময় থাকতে থাকতে কেটে পড়ো, বেরাদর! চাকা ঘুরল বলে!

 কীসের চাকা, কার চাকা এসব তোমরাও জানো, আমরাও কিছুটা;

তবে পৃথিবী-ভর্তি বাবাগুলোর মরে যাওয়া এখনও মায়েদের মনমরা 

করে রেখেছে, যৌনভৃত্যে ঘর ভরিয়ে দেওয়ার পরও তারা ওই

চর্বি থলথলে লোকগুলোর স্মৃতিতে কাঁদে, বিছানায় কাঠ হয়ে পড়ে থাকে।

ভৃত্যেরা চোখ কচলাতে কচলাতে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। বলে

বাবুদের মতো কি আর আমরা পারি? বড় পাপ হল গো! ঘা না হয়ে যায়!

 

পৃথিবী-ভর্তি বাবাগুলো টেঁসে যাওয়ার পর যা পড়ে আছে

তাই দিয়ে এক শীত যা হোক করে পার করে দেওয়া সম্ভব!

তারপর মিহি গলায় তোমরাই বলবে, “উঁহু, এভাবে হবে না!

কীভাবে হবে, তার আবছা চিন্তাও তৈরি হয় না সচরাচর। শুধু হঠাৎ 

ক্রমশ পুরনো, বৃত্তাকার গানগুলো ভাল লাগতে শুরু করবে তোমাদের।

রোদ, ফুল, কুকুরের পর বইপত্রের দিকেও সরে যাবে তোমরা।

 

চাকার নিয়তি এই। ব্যতিক্রম এড়াতে পারে না।

 

 

 

আপেক্ষিক

 

দাঁড়ানো ষাঁড়ের চোখে গাভীবৃন্ত এখনও ইশারা।

গাভী থেকে বহু দূর আমাদের বলয়, বসতি।

অথচ ইশারা ঠিকই ভেসে আসে, চোখে ও বিকারে।

প্রতিবর্ত এই : কেউ একা ঘরে একা ধ্বস্ত হবে...

 

দাঁড়ানো ষাঁড়ের ছায়া বলয় গিলেছে বহুবার।

গূঢ় অর্থ নেই এর, বা হয়তো রয়েছে, তাতে কিছু

যায় আসবার আগে ইশারায় পাগল জনতা

একে অপরের ঘাড়ে নখ রাখে। প্রণোদনা এই।

 

ভাবে মাংস উপাদানগাভী, ষাঁড় উভয়েই এতে

ঘাসের অধিক রক্ত পেয়ে খুব কাম-তৃপ্ত হবে।

অথচ ইশারা ছিল দূরত্বের। প্রচ্ছন্ন যেহেতু,

মানবিক ভুল থেকে অবলীলা উন্মাদনা এল।

 

এতদসত্ত্বেও ষাঁড় গাভী থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না।

এ ভারী আশ্চর্যতার দাঁড়ানো চোখের পরিক্রমা

বহু বৃন্ত ঘুরে ঠিক প্রথম ইঙ্গিতে ফিরে আসে।

বাকি যা বিকার সে তো মানুষ চিন্তক, শপ্ত বলে।

 

বলয়, বসতি রাতে গাভী, ষাঁড় উভয়ই কুপিয়ে

উল্লাস সাজাবে। হত্যা প্রাকৃতিক, নিয়ম, সমাধা।

একা ঘরে একা কেউ দাঁড়ানো ষাঁড়ের চোখ এঁকে

হাতের মুঠোয় বোঝে ইশারা নরম হল। ধীরে।

 

দাঁড়ানো ষাঁড়ের চেয়ে সদ্য মৃত ষাঁড় শ্রেয়তর।

প্রতিবর্ত থেকে এই বিয়োজন প্রকট, জরুরি...

 

 

 

 আবর্ত

 

[‘The mighty dead return, but they return in our colours, and speaking in our voices, at least in part, at least in moments, moments that testify to our persistence, and not to their own.’

                                                                           —Harold Bloom, "The Anxiety of Influence" ]

 

অদ্ভুত ধারাভাষ্যের চিহ্ন ছড়িয়ে ছিল সমস্ত পথে। আমরা হাঁটছিলাম।

মুখের অধিক মুখ, চোখের অধিক চোখ, এবং যা যা অতিরিক্ত কিংবা

শিল্পের পরিপন্থী, তা এড়ানোর বয়স আমাদের কাছাকাছি আসেনি এখনও।

যা বলার জন্য উশখুশ করছে সবাই, তা বলতে না যাওয়ার মধ্যে

বিশেষ পারদর্শিতা ছিল না, মেনে নাও। অথচ আমরা ভেবেছি এই চুপ থাকা

আদ্যোপান্ত মৌলিক, আমরাই একে প্রথমবারের জন্য মুখের মধ্যে

ধরে রেখেছি, আমরাই একে শেষবারের মতো গিলে নেব।

উপরে কিরাতবিন্যাসে নক্ষত্র ছড়িয়ে যাচ্ছে। নীচে ধারাভাষ্যের চিহ্নে

পা ঠেকে গেলে শুরুতে বিকট ভয় হয়, তারপর ঘুম পায়, তারপর হঠাৎ 

মনে পড়েএই হেঁটে যাওয়ার মধ্যে আমরা বহুক্ষণ একে অপরের মুখ দেখিনি।

 

মুখের অধিক মুখ, চোখের অধিক চোখ, পুরুষের অধিক পুরুষ

আমাদের আদ্যোপান্ত মৌলিক হয়ে ওঠার নাছোড় চেষ্টার ভেতর

এতগুলো বিকার এখনও কী করছে? খুব স্বাভাবিকভাবে আমরা 

সেই সমস্ত কিছু বলে দেওয়ার চেষ্টা করছি, যা শিল্পের ধারেকাছেও

আসে না; আসে না যেহেতু, সেহেতু অধিকতর সংকোচের প্রয়োজন জাগেনি।

যা জাগে, তা এই হেঁটে যাওয়াজীবিত বৃদ্ধ কিংবা মরণাপন্ন বালক, 

যে-ই হাঁটতে হাঁটতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে অন্ধকারে, আমরা তার জন্য

কিরাতবিন্যাসের ঠান্ডা চেহারার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করছি অশুচি নিবারণ মন্ত্র।

একে অপরের মুখের দিকে আচমকা তাকালে আমাদের আর স্বস্তি হয় না,

শুধু মনে পড়েএই সাদা ফ্যাকাশে মুখগুলো আমরাই প্রতি দশকে

সশব্দে দাহ করেছি অবিকৃত যত্নে। যা বলতে পারার জন্য আজও উশখুশ করছে সবাই,

তা বলতে না চাওয়ার মধ্যে যে সূক্ষ্ম পূর্ব-অভিজ্ঞতা, তা-ই তো বারবার

ধারাভাষ্যের চিহ্ন (সর্বান্তকরণে পিচ্ছিল) হয়ে ক্রমাগত পুনরাবৃত্ত হচ্ছে।

এত অনপনেয় যাতায়াতের পরও কেউ একে থামাতে পারিনি।

 

অদ্ভুত ধারাভাষ্যের সংসার ছড়িয়ে আছে পথে পথে। আমরা হাঁটছি।

প্রত্যাগমনের শব্দ ধীরে ধীরে কাছে আসছে। কাছে...

 

 

 

ফেম ফাতাল

 

এখানে বীভৎস পর্দা যতবার দেহ ছোঁবে, প্রতিক্রিয়া ছোঁবে,

ততবার অনিয়ত জানলা বেয়ে দৃশ্য ঢুকে চিবাবে তোমাকে।

পালাতে বলিনি, বললে নিরাময় হত, কিন্তু এত উপশম

তোমার হাঁ-মুখে ঢুকে ক্রমে পায়ু-যাতায়াতে মুগ্ধ হয়ে আছে,

এবার সামান্য ধ্বংস প্রয়োজন। মানো বা না মানো।

 

ভাবো কত যোনিমূর্ধা বরাবর সন্দিহান জিভের সরণ

ঘটাতে ঘটাতে তুমি পর্দা চেপে ধরা নারী নারী কিংবা নারী

ধীরে ভ্রান্ত লোহা দিয়ে চিরে চিরে কুহক দেখেছ!

দেখেছ ভেতরে বাষ্প লাল দেওয়ালের মতো অবয়ব বেয়ে

দৃশ্যলোভে ওঠে নামে, জিভের কীলকবৃত্তি সমঝে চলে, আর

নারী নারী কিংবা নারী তোমাকে ঈশ্বরী ভেবে বিকট চেঁচায়;

পর্দা দুলে ওঠে, পর্দা ধাক্কা লেগে ফেটে যায়। মুখে নুন। আয়ু...

 

এখানে দৃশ্যের গোষ্ঠী তোমাকে চিবোতে পারে। গিলতে পারে কই?

নিকষ ছিবড়ের গন্ধ পায়ু-যাতায়াত থেকে অল্প দূরে গিয়ে

ছড়াতে ছড়াতে ক্রমে রটনায় পাল্টে যায়। কৌতূহলী বাড়ে।

এবার সামান্য চিন্তা প্রয়োজন। মানো বা না মানো।

পুরুষ নিজের স্তনে তুষ্ট হতে শিখে যাকএমন বিকার

যত ঘন হবে, তত বিমুখ নারীর দল তোমার হাঁ-মুখে

ঘেন্না, বোঁটা দুই-ই রেখে মর, শালী! মর!বলে ধসে যাবে। ধীরে।

 

প্রতিক্রিয়াশীল পর্দা এখনও কিছুটা ওড়ে, পুরোটা ওড়ে না।

তোমার হাঁ-মুখে দৃশ্য, দৃশ্যের প্রকোষ্ঠে তুমিবিনিময় এই।

 

 

 

নৈশ

 

‘While sleep stays awake, I sleep, 

And in my sleep, I say: I.’

                                           —Paavo Haavikko

 

প্রতারণা ও একাগ্রতা উভয়ই সহচর; প্রতিবার

বরফ চাপাতে চাপাতে মাথা যখন যে-কোনও সম্ভাবনার জন্য

একা এবং তৈরি, তখন অলক্ষ্যে জায়গা বদলের পর

প্রতারণা ও একাগ্রতা একই অভিধার নীচে বমি করতে করতে কাতরায়।

 

স্যাঁতস্যাঁতে মাথা, যা তোমরাও ধীরে ধীরে অভ্যাসে আনছ,

বহু নিষেধাজ্ঞার পরও যা তোমাদের পরিচয়ের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে

জড়িয়ে যাচ্ছে, তা সংরক্ষণের জন্য ঊর্ধ্বগামী

এত বিছানার আয়োজন। কে কোথায় আয়ত চোখ জ্বেলে 

ভববিদ্যা আয়ত্ত করছে, কে কোথায় ঠকে যাওয়ার পর 

হাওয়ায় হাত ঘুরিয়ে গতি বোঝার চেষ্টা করছেএসব থেকে ম্রিয়মাণ

দূরত্বে, খুব সচেতন মৃদু গানের কৌশল বাজছে। শোনো।

 

এরপর যা সন্তর্পণে ভেজা মাথা থেকে আস্তে আস্তে বিচার কেড়ে নেবে

তা-ই ঘুম, তা-ই জাদু কিংবা সন্দেহ (দুটিকে আলাদা ভাবার ভুল

এখনও থামেনি); চারপাশে তাকিয়ে তোমরা তোমাদের অধিক

অযুত একাগ্র প্রতারক খুঁজে পাবে, কিন্তু ওরা যে আদপে তোমরাই, 

এই বিশ্বাসে আসাও তো সহজ হবে না।

 

দূরে, খুব সচেতন কৌশলের গান মৃদু বাজছে। ঘুমাও।

 


No comments:

Post a Comment