নিলাম
(এক)
সকালে পৃথা কাকিমা
ফোন করেছিল কর্ণকে। পৃথা, কর্ণের ছোটোকাকিমা। ছোটোকাকু
মারা যাবার পর ছেলে অর্জুনকে নিয়ে নিউটাউনে ফ্ল্যাট কিনে শিফট্
করেছে। একটা বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করে কাকিমা।
ফোন করেই কাকিমা জানতে
চাইল, তোমার শরীর ঠিক আছে তো কর্ণ?
কর্ণ, ‘হুঁ’, বলতেই কাঁদো
কাঁদো গলায় বলতে শুরু করল, কিন্তু তোমার ভাই অর্জুন ভালো নেই কর্ণ।
—সেকি, কী হয়েছে অর্জুনের?
কোথায় আছে, বাড়িতে না হসপিটালে?
—হসপিটালে। রক্তের প্রয়োজন। ‘ও’ পজিটিভ। তাই তো তোমাকে ফোন করলাম, কর্ণ। শিগগির তুমি
অ্যাপোলোতে চলে এসো। শহরের কোনো ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্ত নেই। এখনই রক্ত লাগবে বলে ফোন এসেছিল হসপিটাল থেকে।
—কিন্তু কাকিমা, আমিও
তো সবে রোভিড থেকে সেরে উঠলাম। এখন তো আমি
রক্ত দিতে পারব না। ডাক্তারের মানা আছে।
ফোনটা কেটে দিল পৃথাকাকিমা। তবে মেসেজে লিখল, রক্তটা পেলে চুঁচুড়ার বাড়ির ওয়ারিশন আমি ছেড়ে দেব
কর্ণ, প্লিজ।
কর্ণ মনে মনে ভাবল তার
শরীরের এক বোতল রক্তের মূল্য এই পৈত্রিক সম্পত্তির অর্ধেকটা!
বাড়িটা কিছু না হোক একশো বছরের পুরোনো। দাদুর বাবার আমলের। এদিকটায় সব বাড়িই ওই সময়ের। বেনেপাড়া। পাশাপাশি সবাই লতায়-পাতায় আত্মীয় হলেও কেউ কারোর বিশেষ খবর নেয় না। এখন তো আরো-ই নয়। পরিস্থিতি
যা হয়েছে এই বাড়ি ছেড়ে কর্ণকেও না মাকে নিয়ে চলে যেতে হয়। গা
লাগোয়া বাড়িগুলোয় প্রবেশ করতে হয় সরু একফালি গলি দিয়ে। গলি এত
সরু যে একটামাত্র সাইকেল বা বাইক ঢোকে কোনোমতে। বাড়িটাও বারেবারে
ভাগ হতে হতে এতই ছোটো হয়ে এসেছে যে উঠোন বলতে তুলসিমঞ্চ আর বাসন মাজার কল।
(দুই)
কর্ণ তখন অফিসে। ফোন
এল সুপ্রিয়ার। সুপ্রিয়া কর্ণের পুরোনো প্রেমিকা। দেখা করতে চাইল নন্দন চত্বরে। কর্ণ একবাক্যে
রাজি হয়ে গেল। কর্ণ এখনও ভালোবাসে সুপ্রিয়াকে।
যদিও সুপ্রিয়া এখন অন্য পুরুষের ঘরনী। অফিস থেকে বেরিয়ে
নন্দন চত্বরে যেতে যেতে দেখল ধূধূ করছে চারিদিক।
রোভিড রোগটা আসার পর থেকেই
রাস্তাঘাটে লোকজন বেরোনো ভয়ানক ভাবে কমে গেছে।
কোভিডের ভয় কেটে গেলেও, ঘরে ঘরে রোভিড আসামাত্রই মানুষ আবার প্যানিকগ্রস্ত হয়ে
পড়েছে। হবে নাই বা কেন। রোভিড হয়নি এমন
মানুষ ভূ-ভারতে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া অনেকেরই বাড়াবাড়ি
হচ্ছে, তখন রক্তের প্রয়োজন হচ্ছে। নিজের গ্রুপের রক্তের মানুষদের
একটা তালিকা সরকার থেকে বানাতে বলা হয়েছে সবাইকে। এই কাজটা ফেসবুকে
খুব দ্রুত সেরে ফেলেছে নতুন জেনারেশন। ‘রক্ত-বন্ধু’ তালিকার মানুষরা
আজকাল হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ বানাচ্ছে। গুগুল মিটে আড্ডা দিচ্ছে।
—কীরে কতক্ষণ? সুপ্রিয়া
আগের মতোই পিছন থেকে এসে চমকে দিল কর্ণকে। আর একটু হলেই কর্ণের
হাত থেকে সিগারেটটা পড়ে যেত। খুব সামলে নিয়েছে।
—বেশিক্ষণ না। চ, হলদিরামে বসে তোর ফেভারিট জুস খেতে খেতে গল্প হবে। সিগারেটের ফিল্টারটা মাটিতে ফেলে বুট দিয়ে ঘষে দিল কর্ণ।
—না রে আজ হবে না। খুব কম সময়ের জন্য এসেছি। ভীষণ দরকার, তাই—
—কী দরকার? রক্ত?
—হ্যাঁরে। তুই কীকরে বুঝলি?
—আমার রক্ত ‘ও’ পজিটিভ। ‘হু’ ঘোষণা করেছে, একমাত্র ‘ও’ পজিটিভ গ্রুপের রক্ত সার্বিক দাতা, সবাইকে দিতে পারবে। তারজন্যই বহু পুরোনো চেনাপরিচিতরা মাঝেমাঝেই ফোন করছে, বাড়ি আসছে…
—শোন না,
আমার ছেলের বয়স আট। ওকে শিশুমঙ্গল হসপিটালে ভর্তি করেছি কাল। সকালে হসপিটাল থেকে রক্তের ব্যবস্থা করতে বলেছে। ওর
গ্রুপ ‘ও’। ওর গ্রুপের কেউ রক্ত দিতে রাজি
হল না। তুই তো গ্রুপে নেই, কিন্তু তোর রক্তের
গ্রুপ আমি জানতাম, তাই… প্লিজ আমার ছেলেটাকে বাঁচা, কর্ণ।
—আমিও তো সবে সেরে উঠলাম,
এখন ছয়মাস রক্ত দেওয়া বারণ ডাক্তারের।
—সেরে উঠেই স্মোক করছিস?
সরি, সেটা তোর ব্যক্তিগত ব্যাপার। শোন, চাইলে তোর সঙ্গে আউটিং-এ যেতেও রাজি আছি। আগে ছেলেটা সুস্থ হোক। প্লিজ, ভেবে দেখ কর্ণ। তুই তো সেবার প্রস্তাব দিয়েছিলিস, মন্দারমণি যেতে।
সেবার যাইনি, প্রমিস, এবার যাব। আমার ছেলেটাকে রক্ত দিয়ে
বাঁচা, কর্ণ।
—আমার একটা কাজ আছে, আজ
আসছি। বলেই হনহন করে হেঁটে নন্দন চত্বর থেকে বেরিয়ে এল কর্ণ। ফাঁকা বাসে উঠে শিয়ালদার টিকিট কাটল। বাসের
জানলার ধারে বসে ভাবছিল, সুপ্রিয়ার সঙ্গে প্রেমের দিনগুলোর কথা। মফস্সলের
সরকারি কলেজ। গঙ্গার ধারের পার্ক। সিনেমাহল…
(তিন)
প্রায় একমাস হতে চলল। মাঝেমাঝেই
পড়শির কারোর, বন্ধুদের, পরিবারের কারোর কিংবা অফিসের কারোর রক্তের
প্রয়োজন লেগেই রইল। কিন্তু কর্ণ সকলকেই একই কথা জানাল, তাকে ডাক্তার
বলেছে অন্তত ছয়মাস রক্ত না দিতে। ব্যাপারটা এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল। এরমধ্যে প্রত্যেককে ‘না’ বলে বলে কর্ণ প্রায় সকল আত্মীয়-বন্ধু বিচ্ছেদ
ঘটিয়ে একলা-জীবন কাটাতে লাগল। এমনকি কর্ণের চাকরিটাও গেল, অফিস
বসের শালির জন্য রক্ত দিতে সম্মত না হওয়ায়।
হঠাৎ একদিন কর্ণের মায়ের
জ্বর এল। মায়েরও রোভিড ধরা পড়ল। মাকে চুঁচুড়া ইমামবাড়া হসপিটালে ভর্তি করা হল। পরের দিনই মাকে রেফার করা হল কলকাতায়। সেখানে ভর্তি
করা মাত্রই হসপিটাল জানাল মাকে রক্ত দিতে হবে। মায়ের রক্তের গ্রুপ
‘বি’ পজিটিভ। মায়ের রক্তের গ্রুপে রক্ত
চেয়ে ফেসবুকে একটা পোস্ট দিল কর্ণ। সঙ্গে সঙ্গে এক সহৃদয় ব্যক্তি
রেসপন্স করল। পোস্টে অবশ্য অনেকে মন্তব্য করল, কর্ণ তাদের চেনা
অনেককে রক্ত দেয়নি। কিন্তু সেই সহৃদয় ব্যক্তি সেসব কথায় কর্ণপাত
করল না। তবে মেসেঞ্জারে কর্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইল। সেদিন দুপুরেই ওরা ক্যালকাটা হসপিটালের সামনে সাক্ষাৎ করল।
সাক্ষাতের প্রথমেই কর্ণ
জেনে নিল, সহৃদয় ব্যক্তিটির নাম সহদেব। কোনো ভনিতা
না করে সহদেব জানাল, যদি কর্ণ তার একটি কিডনি দিতে পারে তবেই সে কর্ণের মাকে রক্ত দেবে।
—আপনি টাকা চান আমি দেব
কিন্তু কিডনি কীকরে দেব?
—টাকা নয়। আমার মায়ের জন্য ‘ও’ পজিটিভ গ্রুপের রক্তের
কারো একজনের একটি কিডনি চাই।
ব্যাপারটা অদ্ভুতভাবে
জটিল হতে লাগল। দু’জনের হাতেই সময় খুব অল্প। হসপিটাল
কর্ণের মায়ের রক্তের জন্য বারবার ফোনে তাড়া দিচ্ছে, এদিকে রোভিড রোগটাতে সবচেয়ে ইমপরট্যান্ট অঙ্গ— কিডনি। ডাক্তাররা টিভিতে ফেসবুকে
সতর্ক করছে, যাতে সকলে কিডনির সুরক্ষা করে। পরিশোধিত জল খায়। রং মেশানো খাবার না খায়। রক্ত পরিশোধিত করতে
কিডনির গুরুত্ব অপরিসীম। অথচ সেই কিডনি দিতে হবে কর্ণকে! নিজের
মাকে বাঁচাতে! সহদেবের মাকেও বাঁচাতে।
ভাবার
জন্য কর্ণ কিছুটা সময় চাইল সহদেবের কাছে। এই সময়টাতে কর্ণ ব্যস্ত
শহরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাবল নিজের বাবার কথা। বাবা সারাজীবন পাতি
একটা প্রাইমারি স্কুলে চাকরি করে, টিউশনি করে, সংসারের জন্য উদয়াস্ত
খেটে, পঁয়ষট্টি বছর বয়সে সুগার ফল করে মারা যান। মার বয়স সত্তর। চোখ বোজা মাত্রই কর্ণ মায়ের আকুতিভরা মুখ দেখতে পেল। চোখ খোলা মাত্রই দেখল সহদেবের মায়ের আকুতিভরা মুখ, সামনে দাঁড়ানো
সহদেবের চোখে যেন খনিকের জন্য ভেসে উঠল। দুই মায়ের মুখের হাসির
মূল্যে তার কিডনি বিকোতে হবে— এটা ভেবে খুব একটা খারাপ লাগছিল না কর্ণের। তৎক্ষণাৎ নিজের বয়সের কথা ভেবে আবার অন্য দুশ্চিন্তায় পড়ল। এখনও বিয়ে করেনি। বাবা মারা যাওয়ার পর মায়ের
অর্ধেক পেনশনে আর নিজের বেসরকারি চাকরির আয়ে মা-ছেলের মোটামুটি চলে যাচ্ছিল। নেহাত পৈত্রিক বাড়িটা ছিল তাই। নাহলে এই বাজারে বাড়ি ভাড়া দিয়ে থাকতে হাড় হিম হয়ে যেত।
দুশিন্তার কি আর শেষ আছে?
দু’দিন আগেই পৃথাকাকিমা পৈত্রিক বাড়িটার অংশ বিক্রির জন্য উকিলের নোটিশ পাঠিয়েছেন। এখন অর্জুন সেরে উঠে হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরেছে। হসপিটালে
অনেক টাকার বিল পেমেন্ট করতে হয়েছে কাকিমাকে। তাই তিনি খুব শীঘ্র
চুঁচুড়া বাড়ির অংশটা বেচে দিতে চান।
এবার মনে মনে বাড়িটা বাঁচাতে
যে টাকা লাগবে সেটা কর্ণ হিসেব করতে লাগল। অ্যাকাউন্টেনসির ছাত্র
কর্ণ। তাই হিসেবটা মুখে মুখে করেও নিল। তারপর
পুরো ব্যাপারটা লাভ-ক্ষতির এক্সেল শিটে ফেলে দেখল, শুধুমাত্র
এক বোতল রক্তের বিনিময়ে একটা গোটা অঙ্গ। তাও আবার কিডনি— দেওয়া
যায় নাকি! অনেক ভেবে চিন্তে তাই এক বোতল রক্তের সঙ্গে সাত অঙ্কের টাকার একটা অ্যামাউন্ট জানিয়ে দিল সহদেবকে।
টাকার অঙ্ক শুনে সহদেব
বলল, আপনার মায়ের রক্ত এখনই চাই, কিন্তু আমার মায়ের জন্য যে কিডনিটা চাই তার জন্য ডাক্তার
কিছুটা সময় দিয়েছেন, ভেবে দেখুন। ঠিক আছে কিছু টাকা নাহয় আমি
দেব। তবে অত নয়। সহদেব পাঁচ অঙ্কের টাকার
অ্যামাউন্টটা বলা মাত্রই আবার কর্ণ হিসেব করতে শুরু করল। হিসেব
করে দেখল, সহদেব যা দেবে বলল, তা দিয়ে কোর্ট ঘর করে পৃথাকাকিমার কাছ থেকে বাড়িটা কিনে
নেওয়া অসম্ভব। তাই টাকার অ্যামাউন্টটা বাড়াতে দর কষাকষি শুরু
করল কর্ণ।
অনেক কথার পৃষ্টে কথার পর সহদেব বলল, আমি ভেবে দেখতেই পারি। কিন্তু
আপনার হাতেই সময় কম। আপনার মায়ের রক্ত এখনই লাগবে। তাই আমি যা দিচ্ছি তাতেই সন্তুষ্ট হওয়া ছাড়া আপনার উপায় নেই।
সময়ের কথা শুনেও হার মানল
না কর্ণ। শেষে ঠিক হল, দু’জনেই দু’জনের প্রস্তাব নিয়ে এক রাত
ভাববে, যে অন্যের প্রস্তাবে সম্মত হবে সে ফোন করে জানাবে।
(চার)
নিশ্চিন্তে ভাববার জন্য ট্রেন ধরে সন্ধের
আগেই চুঁচুড়ায় ফিরে এল কর্ণ। গভীর ভাবনা। ভাবতে
ভাবতে রাত ঘনিয়ে এল। জানলার কাছে যেতেই দেখল চারিদিকের বাড়িগুলোতে
এলইডি লাইট জ্বালিয়েছে। আজ শ্যামাপূজা। ছোটোবেলায়
এই কালীপুজোর সময়গুলো কর্ণরা দেশের বাড়ি যেত। কালীপুজোর পরদিন
গ্রামের বিখ্যাত কালীমন্দিরের সামনে পুজোয় পাওয়া শাড়ি, ফল, মিষ্টি, সিঁদুর, আলতা, ধূপ,
বলির পাঁঠা, সব নিলাম হত। বাবা, মায়ের জন্য দশ-বারো টাকা দিয়ে
ঘরে পরার লালপাড় সাদা শাড়ি নিয়ে আসত, কর্ণের জন্য চার আনার চিনি সন্দেশ, বাড়ির সকলের
জন্য বলির পাঁঠার মুড়ি। পেঁয়াজ, রসুন ছাড়া সেই মুড়ির ঝোলের স্বাদ
কেমন ছিল আজ আর মনে নেই কর্ণের কিন্তু নিলামের কথা স্পষ্ট মনে আছে।
সেদিন
সারা রাত ধরে কর্ণ সেই নিলামের ডাক শুনতে পেল। আর ভোররাতে ফোনটা
এল…
কার ফোন এত সকালে! হসপিটাল
থেকে নয়তো!
বর্তমান সমাজের ছবি।উপরি পাওনা,লেখার ধরণ টি ভালো।
ReplyDeleteঅসংখ্য ধন্যবাদ, প্রতিক্রিয়া পেয়ে আনন্দিত🙏
Deleteবেশ ভালো, জমাটি গল্প।
ReplyDeleteপড়েছো, প্রতিক্রিয়া জানিয়েছো, আমার আনন্দ বাড়িয়ে দিয়েছো ভাই🙏
Deleteবর্তমান সময়ে মধ্যবিত্ত মানসিকতার নিটৌল ছবি। ভালো লাগলো।
ReplyDeleteআনন্দম, ভালো লেগেছে জেনে লেখার উৎসাহ বেড়ে গেল🙏
Deleteমৌসুমীর লেখা বরাবর একটু আলাদা। স্বতন্ত্র । আমি ওর লেখার আগ্রহী পাঠক ।
ReplyDeleteতোমরা পাশে আছো বলেই লেখায় উৎসাহ পাই। আমিও তোমার গল্পের পাঠক বইকি🙏
Deleteভালো লাগলো। গল্পের গতি অব্যাহত। নিলাম গল্প-- মনে গেঁথে নিলাম।
ReplyDelete